বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব
এম সিরাজুল ইসলাম
| তারিখ: ৩০-০৬-২০১৩
সম্প্রতি মার্কিন
পররাষ্ট্র দফতরের
রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার
সেক্রেটারি ওয়েন্ডি
শারম্যান তিন
দিনের সফরে
বাংলাদেশে এসেছিলেন। আদতে
তার এ
সফরে বাংলাদেশের
প্রত্যাশা পূরণ
হয়নি। যদিও
তিনি ঢাকায়
এসেছিলেন বহুমুখী
ফোরামে উভয়
দেশের দ্বিতীয়
বার্ষিক অংশীদারিত্ব
বিষয়ক সংলাপে
অংশগ্রহণ করতে। ফোরামটি
অবশ্য আওয়ামী
লীগ সরকার
ক্ষমতায় আসার
পর প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল। এ
আলোচনায় মানুষের
আশা-প্রত্যাশা
ছিল অনেক। সবার
প্রত্যাশা ছিল,
আগামী নির্বাচনে
অংশগ্রহণে শারম্যান
দেশের প্রধান
দুটি রাজনৈতিক
দলকে সমঝোতায়
আনবেন। স্বাধীনতার
৪২ বছরে
দেশের রাজনীতি
ক্রমেই রুগ্ণ;
বিশেষ করে
দুটি প্রধান
রাজনৈতিক দল
আওয়ামী লীগ
ও বিএনপির
ওপর বিতৃষ্ণা
জন্মায় ফেব্রুয়ারিতে
রাস্তায় নেমে
আসে জনগণ। যেটিকে
বলা হয়
শাহবাগ আন্দোলন। এর
মাধ্যমে একটি
বার্তা দেয়া
হয়, যাতে
ক্ষমতাসীন ও
বিরোধী দল
শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের
মাধ্যমে ক্ষমতা
হস্তান্তর করার
বিষয়টি অনুধাবন
করতে পারে। আওয়ামী
লীগ সংবিধান
সংশোধন করেছে। সংশোধিত
সংবিধান অনুযায়ী,
আগামী নির্বাচন
হবে দলীয়
সরকারের অধীনে। ওই
সরকারের প্রধান
থাকবেন স্বয়ং
প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু
বিএনপির দাবি,
নির্বাচন হবে
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
অধীনেই। তাদের
শঙ্কা, তত্ত্বাবধায়ক
সরকার ব্যতীত
আওয়ামী লীগ
সরকার ও
দলীয় প্রধানমন্ত্রীর
অধীনে নির্বাচন
সুষ্ঠু হবে
না। ২০১১
সালের মে
মাসে আওয়ামী
লীগ সরকারের
অধীনে তত্ত্বাবধায়ক
সরকার ব্যবস্থা
পরিবর্তনের লক্ষ্যে
ত্রয়োদশ সংশোধনীর
পর থেকেই
প্রধান দুটি
দলের মধ্যে
দ্বন্দ্ব তীব্র
হয়েছে। এ
দ্বন্দ্ব আরো
ভয়াবহ আকার
ধারণ করেছে
শাহবাগ আন্দোলনের
পরে। শাহবাগ
আন্দোলনের আগে,
জনগণ অপছন্দ
করে জেনেও
গত চার
বছর ধরেই
নিয়মিত হরতাল
কর্মসূচি দিয়ে
আসছিল বিএনপি।
শাহবাগের আন্দোলন
পর থেকে
বিরোধী দলের
তত্ত্বাবধায়ক সরকার
পুনর্বহালের আন্দোলন
কিছুটা বাঁক
নেয়। এরপর
থেকে শুরু
হয় লাগাতার
হরতাল। বেশির
ভাগ হরতাল
ছিল কঠোর
ও সহিংসতাপূর্ণ। বিরোধী
দল এ
পথটি বেছে
নিয়েছিল সরকারকে
চাপে রাখতে,
যাতে তাদের
দাবি পূরণ
হয়। অন্যদিকে
সরকারি দলও
কঠোর হাতে
দমন করেছে
সহিংসতা।
ওয়েন্ডি শারম্যান
যখন ঢাকায়
এসছিলেন, তখন
দেশের অবস্থা
অতটা খারাপ
ছিল না। তিনি
ঢাকায় পৌঁছেই
অবাধ, স্বচ্ছ,
ও বিশ্বাসযোগ্য
নির্বাচনের আহ্বান
জানিয়েছেন; যার
মাধ্যমে দেশে
গণতান্ত্রিক উপায়ে
দেশের সরকার
পরিবর্তন হয়। তার
কথার অর্থ
করলে দাঁড়ায়
প্রথমত. যুক্তরাষ্ট্র
চায় পরবর্তী
নির্বাচনের মাধ্যমে
বাংলাদেশের বর্তমান
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
দূর হোক। দ্বিতীয়ত.
মূলধারার সব
দলই এ
নির্বাচনে অংশগ্রহণ
করুক। তিনি
ক্ষমতাসীন দলের
কোর্টে বল
চালান করে
দিয়েছেন। বলেছেন,
সরকারকে বিরোধী
দলের সঙ্গে
আলোচনায় বসে
সমস্যার সমাধান
বের করতে
হবে। নির্বাচনে
অবশ্যই বিএনপির
অংশগ্রহণের সুযোগ
করে দিতে
হবে। অর্থাত্
সরকারকে উদ্যোগী
হতে হবে—
তার বক্তব্যে
সেটাই প্রমাণ
হয় সন্দেহ
নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের অতিথির
আগমনে প্রণব
মুখার্জির সফরের
সময়ের ঘটনাই
ঘটিয়েছে বিএনপি। শারম্যান
বিরোধী দলের
সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত
বৈঠক বাতিল
করেছেন। শারম্যানের
সফর চলাকালীন
সময়ে হরতাল
ডেকেছিল বিএনপি। ভারতের
রাষ্ট্রপতির সফরকালীন
সময়েও একই
কাজ করেছিল
বিএনপি। ফলে
এক ধরনের
বিরক্ত হয়ে
বৈঠক বাতিল
করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের
আন্ডার সেক্রেটারি
খালেদা জিয়ার
সঙ্গে বৈঠক
বাতিল করে
এ বার্তাই
দিলেন যে,
তার সরকার
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
হাসিলে হরতাল
কিংবা অন্য
যেকোনো সহিংসতা
অনুমোদন করে
না। রাজনৈতিক
কৌশল হিসেবে
দলগুলোকে বার্তা
দিতে যুক্তরাষ্ট্রের
এ ধরনের
বৈঠক বাতিলকরণের
ঘটনা অবশ্য
এটাই প্রথম
নয়। ২০০৩
সালের জুনে
তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কলিন পাওয়েলও
ওই সময়ের
বিরোধীদলীয় নেত্রী
শেখ হাসিনার
সঙ্গে একই
কারণে (হরতাল)
পূর্বনির্ধারিত বৈঠক
বাতিল করেছিলেন। হরতালের
কারণে বৈঠক
বাতিলের মাধ্যমে
বিএনপিকে এক
ধরনের ‘তিরস্কার’
করায় সরকারি
দল বেশ
খুশিই হয়েছে!
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের
আন্ডার সেক্রেটারি
ক্ষমতাসীন ও
বিরোধী দল
উভয়কেই খুশি
করেছেন। তিনি
উভয় দলকে
নেতিবাচক পন্থা
পরিহার করে
রাজনৈতিক সংকটের
সমাধান বের
করার আহ্বান
জানিয়েছেন। দুই
দল নিজেদের
একরোখা মনোভাব
পরিহার করে
পরবর্তী নির্বাচন
কীভাবে সুষ্ঠুভাবে
অনুষ্ঠিত হতে
পারে, সে
বিষয়ে তেমন
কোনো পরামর্শ
না দিয়েই
আমাদের এক
ধরনের হতাশ
করে দেশে
ফিরে গেছেন। হরতাল
বাংলাদেশের জন্য
চরম ক্ষতিকর;
তিনি যদি
সত্যিই বিষয়টি
নিয়ে উদ্বিগ্ন
হয়ে থাকেন,
তাহলে সম্ভবত
তিনি অবগত
নন যে,
পরবর্তী নির্বাচন
সুষ্ঠু করার
দাবিতে বিএনপি
হরতাল দিয়েই
যাবে।
২০০৩ সালে
কলিন পাওয়েলের
(আওয়ামী লীগবিরোধী
দল থাকা
অবস্থায়) মতো
তিনি বিএনপির
হরতাল নিয়ে
বিরক্ত প্রকাশ
করলেও এমন
কর্মসূচি যে
ফের দেয়া
হবে না,
তা কিন্তু
নয়। অর্থাত্
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক
বহালের দাবি
আদায়ে বারবার
হরতাল দিতেই
থাকবে। ঢাকায়
সরকারের সঙ্গে
আনুষ্ঠানিক বৈঠক
চলাকালে তিনি
বলেছেন, বাংলাদেশ
নিয়ে তার
সরকার খুবই
আশাবাদী। বেশ
জোরালোভাবে ইঙ্গিত
দিয়েছেন যে,
সম্ভাবনা কাজে
লাগাতে পারলে
এ অঞ্চলের
‘অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু’তে (ইকোনমিক হাব)
পরিণত হতে
পারে বাংলাদেশ। তিনি
হয়তো বুঝতে
ব্যর্থ হয়েছেন
চলমান বিপজ্জনক
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
যদি শেষ
না হয়,
তাহলে বাংলাদেশ
দক্ষিণ ও
দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়া— উভয়
অঞ্চলের অন্যতম
‘সন্ত্রাসের কেন্দ্রবিন্দু’তে (টেরোরিজম হাব)
পরিণত হবে। শারম্যান
ও তার
সঙ্গীরা নিয়মিত
কাজের অংশ
হিসেবে কেবল
ঢাকায় আসেননি। তারা
এসেছিলেন আমাদের
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
পর্যবেক্ষণ করতে। যেটি
এ অঞ্চলে
তাদের কৌশলগত
অবস্থানের জন্য
খুবই জরুরি। মিয়ানমারের
সঙ্গে সম্পর্ক
পুনঃস্থাপনেও বাংলাদেশের
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
জড়িত।
সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র
এখন বাংলাদেশের
চলমান পরিস্থিতিতে
তাদের ক্ষমতা
প্রয়োগ বা
প্রভাব দেখাবে
না। কারণ
অতীতের মতো
এবারো হয়তো
প্রধান দুটি
দলের নেতারা
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের
সঙ্গে আলোচনায়
বসবেন। বর্তমান
মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে
মূল ধারার
দলগুলো বিশেষ
করে ক্ষমতাসীন
দলকে উত্সাহিত
ও প্রভাবিত
করতে খুব
কমই দেখা
যাচ্ছে। দেশের
চলমান সংকটের
চোরাবালি থেকে
উঠে আসতে
বিদেশী বন্ধুদের
সহযোগিতা খুব
প্রয়োজন; যেমনটা
হয়েছিল ১৯৭১-এ। যদি বিএনপি
ও জামায়াতের
মতো মূলধারার
দলগুলোর অংশগ্রহণ
ব্যতীত আগামী
নির্বাচন অনুষ্ঠিত
না হয়,
তবে বাংলাদেশ
গভীর সংকটে
পড়বে। গত
এক দশক
কিংবা তারো
বেশি সময়
ধরে পাকিস্তানে
যা হচ্ছে,
বাংলাদেশেও তাই
হবে। তখন
বাংলাদেশ একটি
ব্যর্থ রাষ্ট্রে
পরিণত হবে। পাকিস্তান
তাদের সংকট
উত্তরণে বাংলাদেশ
থেকে তত্ত্বাবধায়ক
সরকারব্যবস্থা ‘ধার
করে’ সুষ্ঠু
নির্বাচন অনুষ্ঠিত
করেছে। এখন
বাংলাদেশ যেন
নিজেদেরই আবিষ্কৃত
উপায় বিলুপ্ত
করে ব্যর্থ
রাষ্ট্রে পরিণত
হতে যাচ্ছে!
আন্ডার সেক্রেটারি
শারম্যানের সঙ্গে
প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা
চলাকালে তিনি
আশাবাদ ব্যক্ত
করেছেন, বিএনপি
পরবর্তী নির্বাচনে
অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচনে
অংশগ্রহণ করতে
সরকার যাতে
বিএনপিকে উত্সাহিত
করে, এ
বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে
গুরুত্ব দিতে
হবে। যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের
বন্ধু, যারা
হরতাল অপছন্দ
করে। যুক্তরাষ্ট্র
তার কৌশলগত
উদ্দেশ্য হাসিল
কারতেই বাংলাদেশের
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
প্রত্যাশা করে। এ
কারণে তারা
নতুন কৌশল
বাস্তবায়ন করতে
ভারত ও
আরব দেশগুলোর
সঙ্গে মিত্রতা
গড়ে তুলতে
আমাদের উন্নয়ন
সহযোগী হিসেবে
কাজ করে
যাচ্ছে। এজন্য
শারম্যান বাংলাদেশে
এসেই বলেছেন,
‘সবার অংশগ্রহণে
অবাধ, স্বচ্ছ
ও বিশ্বাসযোগ্য
নির্বাচন হতে
হবে’। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্ষমতাসীন
দল ও
বিরোধী দল
দেশকে গভীর
সমস্যার দিকে
ঠেলে দিতে
ঠিক এর
বিপরীত পথে
হাঁটছে। ধারণা
করা হচ্ছে,
যুক্তরাষ্ট্র একটি
বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন
চায়। তবে
সদ্যসমাপ্ত সফরে
যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার
সেক্রেটারি বোধহয়
ভুল দরজায়
কড়া নেড়েছেন,
তা বলাই
বাহুল্য।
লেখক: সাবেক
রাষ্ট্রদূত
No comments:
Post a Comment